
দইওয়ালা : দই-দই-ভালো দই!
অমল : দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা!
দইওয়ালা : ডাকছ কেন? দই কিনবে?
অমল : কেমন করে কিনব! আমার তো পয়সা নেই।
দইওয়ালা : কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?
অমল : আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম।
দইওয়ালা : আমার সঙ্গে!
অমল : হাঁ। তুমি যে কত দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছ, শুনে আমার মন কেমন করছে।
দইওয়ালা : (দধির বাঁক নামাইয়া) বাবা, তুমি এখানে বসে কী করছ?
অমল : কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে, তাই আমি সারা দিন এইখানেই বসে থাকি।
দইওয়ালা : আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?
অমল : আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়িনি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওয়ালা তুমি কোথা থেকে আসছ?
দইওয়ালা : আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।
অমল : তোমাদের গ্রাম? অনে-ক দূরে তোমাদের গ্রাম?
দইওয়ালা : আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।
অমল : পাঁচমুড়া পাহাড়-শামলী নদী-কী জানি, হয়তো তোমাদের গ্রাম দেখেছি-কবে সে আমার মনে পড়ে না।
দইওয়ালা : তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?
অমল : না, কোনোদিন যাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি। অনেক পুরোনো কালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম- একটি লালরঙের রাস্তার ধারে।
দইওয়ালা : ঠিক বলেছ বাবা।
অমল : সেখানে পাহাড়ের গাঁয়ে সব গরু চরে বেড়াচ্ছে।
দইওয়ালা : কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গরু চরে বইকি, খুব চরে।
অমল : মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসি নিয়ে যায়-তাদের লাল শাড়ি পরা।
দইওয়ালা : বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয়- কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে!
অমল : সত্যি বলছি দইওয়ালা, আমি একদিনও যাইনি। কবিরাজ যেদিন আমাকে বাইরে যেতে বলবে সেদিন তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?
দইওয়ালা : যাব বইকি বাবা, খুব নিয়ে যাব!
অমল : আমাকে তোমার মতো ওইরকম দই বেচতে শিখিয়ে দিয়ো। ওইরকম বাঁক কাঁধে নিয়ে- ওইরকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে।
দইওয়ালা : মরে যাই! দই বেচতে যাবে কেন বাবা? এত এত পুঁথি পড়ে তুমি পণ্ডিত হয়ে উঠবে।
অমল : না, না, আমি কক্ষনো পণ্ডিত হবো না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কী রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই-ভালো দই।
আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।
দইওয়ালা : হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!
অমল : না, না, ও আমার শুনতে খুব ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক শুনলে মন উদাস হয়ে যায়- তেমনি ওই রাস্তার মোড় থেকে ওই গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল- কী জানি কী মনে হচ্ছিল!
দইওয়ালা : বাবা, এক ভাঁড় দই তুমি খাও।
অমল : আমার তো পয়সা নেই।
দইওয়ালা : না না না না- পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই খেলে আমি কতো খুশি হব।
অমল : তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?
দইওয়ালা : কিচ্ছু দেরি হয়নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয়নি। দই বেচতে যে কতো সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।
[প্রস্থান]
অমল : (সুর করিয়া) দই, দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলায় গরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়, সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই। দই, দই, দই-ই, ভালো দই!
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
ফটিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, "কেমনরে ফটিক, মামার সঙ্গে কলকাতায় যাবি?" ফটিক লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, 'যাব'। 'কবে যাবে, কখন যাবে', করিয়া ফটিক তাহার মামাকে অস্থির করিয়া তুলিল। উৎসাহে তাহার নিদ্রা হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে (পঁচিশে বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, নাট্য-নির্দেশক, অভিনেতা এবং চিত্রশিল্পী। বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তিনি শিক্ষায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'সোনার তরী', 'গীতাঞ্জলি' ও 'বলাকা' প্রভৃতি কাব্য; 'ঘরে বাইরে', 'যোগাযোগ', 'গোরা' প্রভৃতি উপন্যাস; 'বিসর্জন', 'ডাকঘর', 'রক্তকরবী' প্রভৃতি নাটক; 'গল্পগুচ্ছ' গল্পসংকলন। 'শিশু ভোলানাথ', 'খাপছাড়া' প্রভৃতি তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্যে লেখা বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'আমার সোনার বাংলা' গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট (বাইশে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন।
নাট্যাংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। এ নাটিকায় কিশোর অমলকে কবিরাজ ঘরের বাইরে যেতে বারণ করায় সে প্রায় ঘরবন্দি। কিন্তু তার মন পড়ে আছে বাইরের পৃথিবীতে। একদিন অমলের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দইওয়ালার সঙ্গে অমলের ভাব হয়। অমলের মনে বাইরের জগৎ, প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে অনেক কৌতূহল, অনেক প্রশ্ন। সে কখনো দইওয়ালার গ্রামে যায়নি, অথচ তার কল্পনাপ্রবণ মন- ঠিক ঠিক বলে দেয় শামলী নদীর তীরের দইওয়ালার গোয়ালপাড়া গ্রামের নানা দৃশ্যের কথা! দইওয়ালা শুনে অবাক হয়। অমল বলে সে-ও দইওয়ালা হতে চায়। কেননা, সে বই পড়ে পণ্ডিত হতে চায় না। বরং দইওয়ালার 'দই' 'দই' সুরটাই সে শিখে নিতে চায়।
নাট্যাংশটিতে কিশোর মনের কল্পনা, প্রকৃতি ও সহজ-সরল জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেছে।
হাঁকতে হাঁকতে - জোরে শব্দ করে ডেকে কিছু ঘোষণা করতে করতে।
দধি - দই।
বাঁক - বাঁশ দিয়ে তৈরি একধরনের বাঁকানো দণ্ড, যার দুপ্রান্তে মালপত্র ঝুলিয়ে কাঁধে করে বহন করা হয়।
বইকি - নিশ্চয়তা, আগ্রহ ইত্যাদি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়।
কবিরাজ - চিকিৎসক। বনজ উপকরণ দিয়ে চিকিৎসা করেন এমন ব্যক্তি।
গোয়ালপাড়া - যেখানে গোয়ালারা বসবাস করেন।
লোকসান - ক্ষতি।
ভাঁড় - ছোটো মাটির পাত্র।
দোয় - দোহন করে।
পাতে - বানায়। যেমন- দই পাতে দুধ থেকে দই বানায়।